এন্ড্রু কিশোর, একটা ট্রানজিস্টর আর বিশ্বায়নের বাঁধভাঙা ঢেউ
‘সদ্য প্রয়াত এন্ড্রু কিশোরের গলায় যে দরদটা ছিল, সেই দরদ আমি আসলে অন্য কোনো শিল্পীর কাছে পাইনি। তাই আমি বোম্বের কুমার শানু, অনুরাধা পাড়োয়াল, অভিজিৎকে দিয়ে গান করালেও এন্ড্রু কিশোরের প্রতি আমার একটা আলাদা ভালোবাসা ও সম্মান ছিল।’ কথাগুলো বলছিলেন ঢাকার বাংলা সিনেমার সাবেক পরিচালক সৈয়দ হারুনের সঙ্গে, যিনি এন্ড্রু কিশোরকে কাছে থেকে দেখেছেন। তাঁর পরিচালিত ‘বেঈমান’ ছবিতে গাওয়া ‘আজ বড় সুখে দুটি চোখে জল এসে যায়’ গানটির জন্য এন্ড্রু কিশোর পুরস্কার পেয়েছিলেন।
Try Adsterra Earnings, it’s 100% Authentic to make money more and more.
আসলে গান যে একটা দরদের ব্যাপার; এটার সঙ্গে অন্তরের যে একটা সম্পর্ক আছে, তা বোধ করি এন্ড্রু কিশোর যেভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন, অন্য অনেকেই তা পারতেন না। তাঁর গাওয়া ‘আমার সারা দেহ খেও গো মাটি’ গানটি যখন শুনতাম, গায়ের রোম খাড়া হয়ে যেত। এখনো হয়। যেভাবে গাইতেন ‘চোখ দুটো মাটি খেয়ো না, আমি মরে গেলেও তারে দেখার সাধ মিটবে না গো মিটবে না’। কিশোরবেলায় এই গান শুনে ভাবতাম, কী বলেন তিনি এগুলো! বোধবুদ্ধি হওয়ার পরে বুঝেছি, এই গান ভালোবাসার প্রতি একধরনের বিরহ মেশানো আরাধনা। আর নশ্বর মনুষ্য জীবনকে ভালোবাসার নামে মায়ায় বাঁধার জন্য এক হাহাকার ভরা আক্ষেপ—সবই তো একদিন শেষ হয়ে যাবে, কী দরকার ছিল এ রকম গভীর ভালোবাসায় আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধার!
আমার মনে হয়, খুব কম মানুষই আছে, যার হৃদয় ভেদ করে যায়নি এন্ড্রু কিশোরের গান ও গায়কি। তবে আজকের লেখায় এন্ড্রু কিশোরের গায়কি ছাড়াও আমি তুলে আনতে চাই এন্ড্রু কিশোরের এন্ড্রু কিশোর হয়ে ওঠা আর কিছুটা নীরবে হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আমাদের পরিবর্তিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর কথা। প্রত্যেক শিল্পীর শিল্পী হয়ে ওঠা ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত স্ট্রাগল ছাড়াও পারিপার্শ্বিক আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অর্থনীতি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। আর এন্ড্রু কিশোরকে নিয়ে গবেষণায় দেখা যাবে তাঁর উত্থানের সময়টাতে ছিল আমাদের একধরনের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, যা রাজনীতিরই অংশ।
আমি যখন এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠ শুনি, তখন আমি কিশোর। নব্বই দশকের শুরুর দিকে বেড়ে উঠছি ঢাকায়। ঢাকা তখনো অনেক বাসযোগ্য। বাতাসে অতটা দূষণ নেই, রাস্তায় অত যানজট নেই, আমাদের কাছে আজকের মতো গণমাধ্যমের এত ব্যাপকতা নেই, নেই ফেসবুক, এমপিথ্রি, ইউটিউব, স্পটিফাইয়ের মতো মাধ্যম। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে তখন একমাত্র গণমাধ্যম ছিল আমার মায়ের একটি ট্রানজিস্টর রেডিও। যেখানে শুনতাম বাংলাদেশ বেতারের বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠান। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শুনতাম বিজ্ঞাপন তরঙ্গ। আর বিজ্ঞাপন তরঙ্গ মানে বাংলা ছায়াছবির গান, এন্ড্রু কিশোরের একার গান অথবা রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীনের সঙ্গে ডুয়েট। ভালোবাসার গান, বিরহের গান, মারফতের গান। মনে আছে এন্ড্রু কিশোরকে ছোটবেলায় আবিষ্কার করি ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’ গানটার মধ্যে দিয়ে। মৃত্যুর ছায়ায় যে জীবন চলে, এই বোধ ছোটবেলা থেকে বোধ হয় এই গানের মধ্যে দিয়েই হয়।
আসলে এন্ড্রু কিশোরের গানের পেছনে তখন আমাদের সমাজের কিছু প্রতিচ্ছবিও ফুটে ওঠে। যেমন তখন চলচিত্র ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম। সঙ্গে ছিল বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন। তখন মধ্যবিত্ত টিকিট কেটে সিনেমা হলে সিনেমা দেখত। আমাদের জীবনে বাংলা চলচ্চিত্রের একটা প্রভাব ছিল। গানগুলোর একটা চাহিদা ছিল। এ কারণেই সরকারি গণমাধ্যমেই এই গানগুলোর আবার রিডিস্ট্রিবিউশন হতো—এভাবে সমাজে তৈরি হতো বাংলা চলচ্চিত্রের সাংস্কৃতিক আধিপত্যর কাঠামো। আর এই সাংস্কৃতিক কাঠামোয় এন্ড্রু কিশোর ছিলেন একচ্ছত্র সুরের যুবরাজ। কোটি মানুষের ভালোবাসার মানুষ। তার গানে মানুষ তখন ভালোবাসে, স্বপ্ন দেখে, বিরহের আর্তি গাঁথে।
আর এই সাংস্কৃতিক কাঠামোর পেছনের অর্থনীতির গল্প বলে, বাংলাদেশ তখনো বিশ্বায়নের যুগে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি তখনো এতটা শক্তভাবে ভিত গাড়েনি বাংলাদেশে। ফলে এখনকার মতো এত উদ্যোক্তা, নব্য ধনীও গড়ে ওঠেনি। সিনেমা হলের স্ক্রিন আর টিভি স্ক্রিনের বাইরে তখন ছিল না এত এত স্ক্রিন (স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, আইপ্যাড)। এন্ড্রু কিশোর যখন মানুষের হৃদয় কাঁপাচ্ছেন, বাংলাদেশ তখনো গড়ে ওঠেনি এত প্রাইভেট টিভি চ্যানেল অথবা রেডিও চ্যানেল। তাই এখনকার মতো নানামুখী সাংস্কৃতিক চাহিদার জোগান দিতে গিয়ে এখনকার মতো এ দেশের মানুষের কাছে পৌঁছায়নি নানা রকম সাংস্কৃতিক পণ্য।
কিন্তু দেশের দৃশ্যপট ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে। বিদেশি বিনিয়োগ আসতে শুরু করে বাংলাদেশের গার্মেন্টস ও কম্পিউটার সফটওয়্যার শিল্পে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আর সরকারি চাকরিজীবী হওয়া ছাড়াও যে একজন ব্যবসায়ী হতে পারে, উদ্যোক্তা হতে পারে, এই ধারণাগুলো ব্যাপকতা লাভ করে। মূলধনের নানামুখী প্রবাহের সঙ্গে আসে স্যাটেলাইট টিভি, প্রাইভেট টিভি চ্যানেল, ইন্টারনেটভিত্তিক স্ট্রিমিং সার্ভিস। সংস্কৃতি ধীরে ধীরে আবদ্ধ হতে থাকে নানা রকম ‘কনটেন্টে’। পরিবর্তন আসতে থাকে আমাদের সাংস্কৃতিক পণ্যের উপস্থাপন ও বিপণনে। একসময়ের তুমুল জনপ্রিয় মঞ্চনাটকের জায়গা হয় টেলিভিশন স্ক্রিনে আর এখন টেলিভিশন স্ক্রিন থেকে ইউটিউবে। চলচ্চিত্রও একসময় হারিয়ে ফেলে তার গুরুত্ব, প্রথমে সিনেমা হলে দর্শক কমতে শুরু করে, তারপরে বাংলাদেশ বেতারের শ্রোতা কমা শুরু করে, কারণ তত দিনে বোম্বের আর হলিউডের ছবির ও গানের প্রভাব বেড়েছে। দেশীয় নানা রকম উদ্যোক্তা নিয়ে আসেন নানা রকম মাধ্যম আর এখন তো চলচিত্র মানে নেটফ্লিক্স অথবা আমাজন প্রাইম!
বিশ্বায়ন, মূলধন আর সংস্কৃতির পরিবর্তনের এই যে দ্রুত পরিবর্তনশীল ধারা, এই ধারায় চিড়েচ্যাপটা হয়ে হারিয়ে গেছেন অনেকে, অনেকে খাপ খাইয়ে এর সুফল ভোগ করেছেন। কিন্তু সমস্যায় পড়েছেন অনেক শিল্পী। কারণ এখন শিল্পী আসে ‘তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ নামক টিভি প্রোগ্রাম থেকে। যার পেছনে মোবাইল ফোন কোম্পানি ও টেলিভিশন চ্যানেলের একটা ব্যবসায়িক মডেল আছে—এ রকমই হওয়ার কথা। কারণ, মূলধন বা ক্যাপিটাল সব সময় ‘ইনোভেশন’ খোঁজে। আর ক্যাপিটাল প্রোমোট করে সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি সেক্যুলার হতে পারে, এই সংস্কৃতি ধর্মীয়ও হতে পারে।
এর ফলে যেটা হয় আমাদের সমাজে কোনো একটা মাধ্যম আর সাংস্কৃতিক আধিপত্য বজায় রাখতে পারেনি। ছোট ছোট ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে সংস্কৃতির মণ্ডল। ব্যান্ডসংগীতের এক রকম শ্রোতা, চলচিত্রের এক ধরনের দর্শক, হিন্দি গানের একধরনের শ্রোতা ইত্যাদি। এর প্রভাব পড়েছে শিল্পীমহলেও। এন্ড্রু কিশোরও এর বাইরে নন। বিশ্বায়নের অবাধ সাংস্কৃতিক ঢেউ এন্ড্রু কিশোরকে হয়তোবা আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকে কিছুটা দূরেই রেখেছিল, কিন্তু আমরা তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। ওপারে ভালো থাকবেন সুরের মহারাজ।
মোবাশ্বার হাসান: রিসার্চ ফেলো, ডিপার্টমেন্ট অব কালচারাল স্টাডিজ অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজ। অসলো ইউনিভার্সিটি, নরওয়ে।
More Story on Source:
*here*
এন্ড্রু কিশোর, একটা ট্রানজিস্টর আর বিশ্বায়নের বাঁধভাঙা ঢেউ
Published By
Latest entries
- allPost2024.11.22Hazard za darmo dzięki SlotsUp Graj wyjąwszy Rejestrowania się
- allPost2024.11.22Hazard Online darmowo Automaty Do Komputerów Sieciowy
- allPost2024.11.22Polskie Kasyna Internetowego Najistotniejsze Automaty do odwiedzenia Komputerów bezpłatnie
- allPost2024.11.22Automaty Online 2024 Ustawowe & Automaty Dzięki Finanse