দৈনিক জনকন্ঠ || যেন নির্ভয়ে কাটানো যায় বছরটি
- রণেশ মৈত্র
দেখতে দেখতে অশ্রু ঝরাতে ঝরাতে বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করতে করতে চলেই গেল দুটি বছর, ২০২০ ও ২০২১- সাকুল্যে ৭৩০ দিন। বিভীষিকাময় এ দুটি বছরে বাংলাদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক, গবেষক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সামাজিক আন্দোলনের নেতা, নারীনেত্রী, অভিনেতা, সাংবাদিক থেকে শুরু করে হেন সম্প্রদায় নেই যে সম্প্রদায়ের বিশিষ্টজনেরা এমন একজনকেও হারাননি এই বিগত দুটি বছরে।
Try Adsterra Earnings, it’s 100% Authentic to make money more and more.
ইচ্ছে ছিল তেমন যাঁদেরকে হারালাম তাঁদের স্মরণেই যখন লেখাটা শুরু করলাম, তখন তাঁদের, যাঁদের কথা বলছিলাম, সবার নাম উল্লেখ করব। কিন্তু স্মৃতিশক্তি ততটা সাহায্য না করায় যাঁদেরকে মনে পড়ছে তাঁদেরকেই উল্লেখ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি পুনর্বার।
তাঁরা হলেন জাতীয় অধ্যাপক, আমার বাল্যবন্ধু, বাংলা একাডেমির সাবেক চেয়ারম্যান ও সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের উপদেষ্টা ড. আনিসুজ্জামান, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা অজয় রায়, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউদ্দিন তারিক আলী, বন্ধুবর কামাল লোহানী, জাতীয় অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা, সাবেক এম.পি ও মন্ত্রী অনুজপ্রতিম মোহাম্মদ নাসিম, সরকারী কৌঁসুলি, সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল প্রবীণ আইনজীবী মাহবুবে আলম, প্রখ্যাত সাংবাদিক রাহাত খান, গীতিকার আলাউদ্দিন আলী, বিজ্ঞানী অধ্যাপক আলী আজগর, ভাষাসৈনিক ও প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশির, নারীনেত্রী ও বন্ধুপতœী রাখিদাস পুরকায়স্থ, বীর মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী, কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর, ভাষাসৈনিক নওগাঁর জননেতা এম. এ. রকিব, স্থপতি মৃণাল হক, অধ্যাপক রিয়াজুল ইসলাম, প্রখ্যাত সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, যাঁকে ঘিরে বহু স্মৃতি আজও মনের কোণে ভাসে। বন্ধুবর কবি ও নাট্যবিদ এবং অধ্যাপক, পাবনার অন্যতম অহঙ্কার ও আমার কলেজজীবনের সহপাঠী জিয়া হায়দারের ভাই বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক রশিদ হায়দারের নামও মনে পড়ছে। ইতোমধ্যে পাবনার অপর আওয়ামী লীগ নেতা সাঈদুল হক চুন্নও করোনাসহ নানা রোগে ভুগে মৃত্যুবরণ করলেন। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপ্রতি প্রণব মুখার্জী, বাংলাদেশের পরম বন্ধু প্রণব মুখাজীর নামও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। আরও বহু নাম স্মরণে আনতে পারলাম না বলে মনে কষ্ট অনুভব করি। তবে তা ইচ্ছাকৃত নয়। কায়মনোবাক্যে কামনা করি এই নিবন্ধটি ছাপা হওয়ার আগে ও পরে আর যেন এমন আপনজনদের করোনা বা অন্য কোন দুর্ঘটনায় অস্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করতে না হয়।
‘জন্মিলে মরিতে হবে-অমর কে কোথা কবে’- কবির এ অমোঘ বাণীর সত্যতা চিরকাল সত্য হিসেবে বিরাজ করবে এবং মানুষের মৃত্যু অলংঘনীয় হওয়ায় তাও বজায় থাকবে এ কথা সবারই জানা। এর কোন ব্যত্যয় কোনদিনই হবে না সত্য। তবে জোর দিয়ে বলি, সকলের জন্য স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।
পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু
মৃত্যুর মিছিল বিগত দুই বছরে অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ হয়েছে। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় যেন জীবনকে হাতের মুঠোয় আটকে রেখে বেরোনোর কথা ভাবতে হয় সকলকেই। বাড়ি থেকে বেরোনো যাবে কিন্তু কাজ শেষে বা যাবার কিংবা আসবার পথে জীবনবায়ু নির্বাপিত হবে না; এমন সামান্যতম নিশ্চয়তা নেই। বাস দুর্ঘটনায় সারাদেশে প্রতিদিন একাধিক যাত্রী ও চালকের মৃত্যু যেন নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-
এক. লক্কড়ঝক্কড়মার্কা গাড়ি নিকট ও দূরপাল্লায় চালানো। অনৈতিকভাবে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া;
দুই. চালকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়াই দিব্যি তাদেরকে ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করা;
তিন. রাস্তার অপ্রশস্ততা, বাঁকগুলোরও অপ্রশস্ততা এবং বাঁকে অনেক ক্ষেত্রে উঁচু-নিচু থাকায় সামনের গাড়ির দূরত্ব পেছন থেকে দেখতে না পাওয়া;
চার. নানা সময় নানারকম বাগাড়ম্বর করলেও বিটিআরসিকে দুর্নীতিমুক্ত করা বা পথ-ঘাটের পরিস্থিতির আদৌ দেখভাল না করা;
পাঁচ. রাস্তাগুলোর ভার বহন সক্ষমতার বহু বেশি মালামাল ট্রাকগুলোতে অবাধে বহন করতে দেয়া;
ছয়. রাস্তার কথা না ভেবে সমানে নতুন নতুন গাড়ি রাস্তায় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নামতে দেয়া এবং
সাত. ছোট্ট এই দেশে রাস্তাঘাটের মারাত্মক অপ্রতুলতা উপেক্ষা করে পরিকল্পনাহীনভাবে প্রাইভেট গাড়ি ক্রয়-বিক্রয় এবং চলাচলের লাইসেন্স প্রদান।
এ থেকে নিষ্কৃৃতি পেতে এবং পথে-ঘাটে মানুষকে অসহায় মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে হলে পরিবহন আইনের দৃঢ়তার সঙ্গে সঠিকভাবে প্রয়োগ এবং এই সেক্টরকে দুর্নীতিমুক্ত করতেই হবে। এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি এবং ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’ ঘটার পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি পরিলক্ষিত হলেও কিছুকাল পরই যে কে সেই।
সরকারের বিআরটিসি দোতলা বাস ঢাকাসহ সর্বত্র ব্যাপকভাবে চালান সঙ্কটের কিছুটা লাঘব হতে পারে। কিন্তু এ জাতীয় শুধু উদ্যোগ নিতেই দেখা গেছে। বেসরকারী গাড়ির মালিকেরা তার বিরোধিতাই শুধু করেনি, বরং শ্রমিকদের লেলিয়ে দিয়ে বিআরটিসির গাড়িগুলোকে ভাঙচুর করেছে। কিন্তু সরকার এ অপরাধের দায়ে আজতক কারও বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বরং নীরবে আত্মসমর্পণের পথে হেঁটেছে।
নদীপথও বিপদ সঙ্কুল!
চিরকাল, বিশেষ করে বাল্যকাল থেকে যৌবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জেনে এসেছি নদীপথে যাতায়াত সর্বাপেক্ষা স্বল্পব্যয়, নিরাপদ, আনন্দদায়ক ও পরিবেশ সহায়ক। এ কারণেই সম্ভবত বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাদেশের নানাস্থানে যাতায়াত নৌপথেই করতেন এবং সেজন্য তাঁর মালিকানাধীন একটি বজরার ব্যবস্থাও করেছিলেন। শাহজাদপুর, শিলাইদহ নদীর ঘাটে তা বাঁধা থাকত।
জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকেও দেখেছি তিনি নৌকা থেকে নেমে জনসভায় যেতেন, জনসভা শেষে নৌকায় এসে উঠতেন। তিনি বলতেনও, একটু সময় বেশি লাগে বটে; কিন্তু নৌকাতে চলাফেরা, এমনকি দিনরাত কাটানো অনেক স্বাস্থ্যকর। তিনি জীবনের বেশিরভাগই নৌকা ব্যবহার করেছেন বলে শুনেছি। তাঁর রান্নাবাড়ার ব্যবস্থা নৌকাতেই ছিল। মাঝিদের মধ্যে কেউ না কেউ রান্নাবাড়া করে খাওয়াতেন। মাটির চুলাও থাকত নৌকাতেই।
তখন অবশ্য যান্ত্রিক নৌকার আবির্ভাব ঘটেনি। যান্ত্রিক যানবাহন নদীতে চলাচল শুরু হওয়ার পর শুরু হয় নৌপথে দুর্ঘটনার পালা। এর ভয়াবহতম ঘটনা এই সেদিন ঘটে গেল সুগন্ধনা নদীতে একটি চলন্ত লঞ্চে। এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত অগ্নিদগ্ধ ৫০ জনের মৃত্যু, বিপুলসংখ্যক হাসপাতালে ও বাদ বাকির হদিস মেলেনি। ঘটনাটা ঘটল লঞ্চে ইঞ্জিন থেকে আগুন লেগে নিমেষেই দগ্ধ হয়ে গেল শতাধিক মানুষ। ফায়ার ব্রিগেড, ডুবুরি অক্লান্ত পরিশ্রম করে সাধ্যমত মানুষ বাঁচালেন। যদিও অগ্নিদগ্ধ মানুষ কয়জনইবা বাঁচবে! তবে অন্তত লাশগুলোর সন্ধান তো তারা বের করেছেন, উদ্ধার করেছেন, স্বল্পসংখ্যক হলেও বাঁচিয়েছেন।
প্রশ্ন জাগে, ইঞ্জিন কি ভাল ছিল? এর কোন সার্টিফিকেট ছিল? অগ্নিনির্বাপণের কোন ব্যবস্থা ছিল কি? থাকলে তা কি ব্যবহার করা হয়েছিল? সম্পূর্ণ যানটি কি চলাচল উপযোগী ছিল? তার ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল কি আদৌ? অতিরিক্ত যাত্রীবহন, অচল ইঞ্জিন, আকস্মিক অগ্নিকাণ্ড, তলা দিয়ে জল উঠে যানটি অকস্মাৎ যাত্রীসহ ডুবে গিয়ে যাত্রীদের মর্মান্তিক মৃত্যু প্রায় প্রতি বছর ঘটে চলেছে। একটি কথা বলা চলে, ঐ যানটি বাস্তবিক অর্থেই বহু পুরনো এবং তার চলাচলের মেয়াদ বহু আগেই শেষ হয়েছে। মালিকেরা দিব্যি এগুলো চালিয়ে যাচ্ছেন, কর্তৃপক্ষ নির্বিকার, মানুষ অসহায়। তাই জলপথে আমরা প্রতি বছর কত শত মানুষকে হারাচ্ছি তা অজানাই থেকে যাচ্ছে।
আকাশপথে দুর্ঘটনা
এই দুর্ঘটনা পৃথিবীব্যাপী ঘটে চলেছে। বছরে কতগুলো দুর্ঘটনা ঘটে থাকে তাও জানা ভীষণ কঠিন। তবে গুগলস্ েখুঁজলে নিশ্চয়ই সে সন্ধান পাওয়া যাবে। এই দুর্ঘটনা সাধারণত নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত এবং একজন যাত্রীরও বাঁচার সম্ভাবনা থাকে না বললেই চলে।
আমাদের বিমানবন্দরটি ছোট। অল্পসংখ্যক আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল করে। তাই দুর্ঘটনা প্রায় ঘটেই না। নতুন টার্মিনাল নির্মাণের পর যখন শত শত ফ্লাইট ওঠানামা করবে তখন স্বভাবতই কিছু দুর্ঘটনা ঘটলেও ঘটতে পারে। তবে তা না ঘটুক এমনটাই আকাক্সিক্ষত।
করোনায় বিদগ্ধজনদের আর যেন হারাতে না হয়- এমন আকাক্সক্ষা অবশ্যই যথার্থ। সকল মৃত্যুই বেদনার। কিন্তু গুণী, প-িত, শিল্পী-সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিকদের মৃত্যুজনিত ক্ষতি সর্বাধিক বেদনাদায়ক। তারপরেও বলি, সকল প্রকার মৃত্যুই বন্ধ হোক। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই সর্বত্রই।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক